কেউ চড়েছেন ঘোড়ার গাড়িতে, কেউ-বা যন্ত্রচালিত নৌকায়। কেউ পরেছেন শাড়ি, কেউ ধুতি-পাঞ্জাবি পরে সেজেছেন লাঠিয়াল, বাউল, দইওয়ালা। আবার কারও সাজ মাথায় গামছা বেঁধে হাতে বৈঠা নিয়ে সাম্পান মাঝির, কেউ বা আবার সাপুড়ে। কারও কণ্ঠে গান, কারও কণ্ঠে স্লোগান।
এভাবেই শনিবার (১৩ এপ্রিল) বিকেলে হাজারো মানুষ সমবেত হয়েছিলেন নগরীর লালদিঘী চত্বরে। ঈদুল ফিতরের আনন্দে বাড়তি মাত্রা দিতে প্রতিবছরের মতো এবারও আয়োজন করা হল ‘চাটগাঁইয়া ঈদ আনন্দ উৎসব’। নগর সংস্কৃতির আধিপত্যকে একপাশে রেখে এদিন নাচে-গানে, বর্ণাঢ্য আয়োজনে তুলে ধরা হল চট্টগ্রামের চিরায়ত সংস্কৃতিকে।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আন্দরকিল্লা ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জহরলাল হাজারী তিনবছর ধরে ‘চাটগাঁইয়া ঈদ আনন্দ উৎসব’ নামে নতুন এই আয়োজন শুরু করে আসছেন। এ উৎসব এখন চট্টগ্রামের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের সম্মিলনের উৎসবে পরিণত হয়েছে।
শনিবার দুপুর থেকে উৎসবে যোগ দিতে নগরীর নানা প্রান্ত থেকে দলে দলে মানুষ আসতে থাকে। বিকেল গড়াতেই তৈরি হয় উপচে পড়া ভিড়। তুমুল করতালি আর হর্ষধ্বনির মধ্যে একুশে পদকপ্রাপ্ত গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব এম এ মালেক উৎসবের উদ্বোধন ঘোষণা করেন। প্রধান অতিথি ছিলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। উদ্বোধকসহ অতিথিরা সবাই চট্টগ্রামের ভাষায় বক্তব্য দেন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী, সংসদ সদস্য এম এ লতিফ, সিএমপি কমিশনার কৃষ্ণপদ রায়, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা আমিনুল ইসলাম আমিন, কাউন্সিলর জহরলাল হাজারী, চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সহ সভাপতি চৌধুরী ফরিদ, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় যুব ও ক্রীড়া উপ-কমিটির সদস্য নুরুল আজিম রনি, কাউন্সিলর রুমকি সেনগুপ্তাও ছিলেন।
উৎসবের উদ্বোধন ঘোষণা করে এম এ মালেক বলেন, ‘চট্টগ্রামের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ভাষা আমাদের টিকিয়ে রাখতে হবে। চট্টগ্রামের ইতিহাস আমরা যেন ভুলে না যায়। আমাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি আমাদের এগিয়ে যাবার শক্তি। চাটগাঁইয়া উৎসবের ধারাবাহিকতা রাখতে হবে।’
প্রধান অতিথির বক্তব্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, ‘আমাদের নেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সবসময় বলেন- ধর্ম যার যার উৎসব সবার। আমরাও বলি। আজ চাটগাঁইয়া ঈদ আনন্দ উৎসবে সেটা আরেকবার প্রমাণ হয়েছে। উৎসবে হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিস্টান সবাই শামিল হয়েছেন। আমাদের দেশে যখন প্রবারণা পূর্ণিমার সময় ফানুস ওড়ানো হয়, তখন সব সম্প্রদায়ের মানুষ তাতে শামিল হন। দুর্গাপূজার যে উৎসব হয়, তখনও সব সম্প্রদায়ের মানুষ শামিল হন। উৎসবে আমরা হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিস্টান সবাই মিলেমিশে একাকার।’
মন্ত্রী আরও বলেন, ‘হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিস্টান সবার মিলিত রক্তস্রোতে আমাদের এদেশ রচিত হয়েছে। আমরা সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ রচনা করেছি। এদেশে কোনো সাম্প্রদায়িক অপশক্তির স্থান হবে না। কেউ সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করতে চাইলে তাদের প্রতিহত করা হবে, সবসময় করেছি, ভবিষ্যতেও করবো।’
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ‘আঁরা চাটগাঁইয়া নওজোয়ান, দইজ্জ্যার কূলত বসত গড়ি সিনাদি ঠেহাই ঝড়-তুয়ান। আমরাই বীর চট্টগ্রাম। কেউ আমাদের দাবিয়ে রাখতে পারে না। চট্টগ্রামের ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে। সেই ঐতিহ্য ধরে রাখতেই আমাদের কাউন্সিলর জহরলাল হাজারী প্রতিবছর চাটগাঁইয়া ঈদ উৎসবের আয়োজন করেন। আমি তাকে ধন্যবাদ জানাই।’
উদ্বোধনের পর বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের হয়। নগরীর বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে শোভাযাত্রা আবার লালদিঘী চত্বরে গিয়ে শেষ হয়। এতে শিল্পী, সংস্কৃতিকর্মী, রাজনৈতিক নেতাকর্মীসহ হাজারো মানুষ অংশ নেন।