আমির হোসেন, ঝালকাঠি প্রতিনিধিঃ
বাংলার ইতিহাস ঐতিহ্যের অনেক কিছুই আজ বিলুপ্তির পথে। এগুলোর মধ্যে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী উৎসবের মধ্যে অন্যতম হল ঘোড়ার দৌড় (ঘোড়দৌড়) প্রতিযোগিতা। কালের বিবর্তনে আজ হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রামবাংলার জনসাধারণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণমূলক এ খেলাটি। তবে এখনও দেশের কোথাও কোথাও এটি সবান্ধব উপস্থিতিতে আয়োজন করা হয়ে থাকে। স্থানীয় কিছু কিছু সংগঠকেরা এখনও এ খেলার আয়োজন করে বাংলার ঐতিহ্যটি ধরে রাখার নিরন্তর চেষ্টা করে থাকেন। এভাবেই হারিয়ে যাওয়া বাংলার ঐতিহ্যবাহী ঘোড়াদৌড় খেলাটির পুনঃসংযোজন ঘটে।
সম্প্রতি ঝালকাঠি জেলার রাজাপুর উপজেলার মঠবাড়ি ইউনিয়নের পুখরিজানা গ্রামে স্থানীয় মিলবাড়ি সততা-একতা ক্লাবের উদ্যোগে এ ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতার ও গ্রামীন মেলার আয়োজন করা হয়। প্রতি বছর নিয়মিত আয়োজনেরই অংশ হিসেবে এবছরও ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা ও মেলার আয়োজন করা হয়।বৃহস্পতিবার (০৮ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে তিন দিনের এ প্রতিযোগীতা শেষে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকারী ঘোড়ার মালিকদেরকে পুরুস্কার বিতরণ করা হয়।
ঘোড়দৌড় উপলক্ষে নানা সাজে সজ্জিত হয়ে টগবগিয়ে খুরের আওয়াজ তুলে ছুটে যায় রঙ-বেরঙের ঘোড়া। সাজে সজ্জিত হয়ে ছুটে চলে ঐতিহ্যের ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা। এ ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা ও মেলা উপভোগ করতে ঝালকাঠি জেলাসহ পার্শ্ববর্তী উপজেলাগুলো এবং বিভিন্ন জেলা থেকে হাজার হাজার মানুষ আসে। এতে শিশু-কিশোর, নারী-পুরুষ ষাটোর্ধ বয়স্কসহ নানা শ্রেণীপেশার হাজারো মানুষের ভিড় হয়। ঘোড়াদৌড় দেখতে আগের দিনই স্থানীয়দের বাড়ি ভরে যায় আত্মীয়-স্বজনে।
সকাল থেকে হাজার হাজার নারী-পুরুষসহ বিভিন্ন বয়সী শিশুরা মাঠে জড়ো হতে থাকেন। উৎসবমুখর পরিবেশে ঘোড়ার দৌড় ও সওয়ারিদের রণকৌশল উপভোগ করতে মাঠের দুই প্রান্তে হাজির হয় শত শত দর্শনার্থী। তারা মাঠের দুই পাশে দাঁড়িয়ে ঐতিহ্যবাহী এই ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা উপভোগ করেন। খেলা শুরু হলে মাঠের চারদিকে হাজারো দর্শকের উচ্ছ্বসিত আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে। দুরন্ত গতিতে ছুটে চলে ঘোড়া আর সেই ঘোড়দৌড় দেখে উৎসাহিত নানা বয়সের দর্শনার্থীরা। দর্শকের মুহুর্মুহু করতালি আর চিৎকারে অন্যরকম আনন্দ বয়ে যায়। এ যেনো চিরায়ত বাঙালির চিরচেনা মিলনমেলা। এই প্রতিযোগীতায় কাঁঠালিয়া উপজেলার, ভান্ডারিয়া উপজেলার, রাজাপুর উপজেলার, বেতাগী উপজেলারসহ বিভিন্ন উপজেলার ৮ টি ঘোড়া অংশ নেয়। গ্রাম-বাংলার হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী এ প্রতিযোগিতা দেখে মুগ্ধ হয়েছেন আগত দর্শকেরা।
ঘোড়দৌড় দেখতে আসা সোবহান বলেন, আমি পরিবার নিয়ে ঢাকা থেকে ঘোড়দৌড় দেখতে এসেছি। আমার ঘোড়দৌড় দেখতে অনেক ভালো লাগে। ভালো লাগে থেকেই এখানে আসা। আমি প্রতি বছর এখানে ঘোড়দৌড় দেখতে আসি।
ঘোড়াদৌড় দেখতে আসা সাকিব বলেন, আমি চট্টগ্রাম থেকে ঘোড়াদৌড় দেখতে এসেছি। প্রতি বছর ধরে এখানে ঘোড়াদৌড় অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আমি প্রতি বছর এখানকার ঘোড়াদৌড় দেখতে আসি। এবছরও এসেছি। আমি চাই প্রতি বছর যেনো এখানে ঘোড়াদৌড় ও গ্রামীন মেলা অনুষ্ঠিত হয়। ঘোড়াদৌড় দেখতে খুব ভালো লাগে।
ঘোড়াদৌড় দেখতে আসা জান্নাতি বলেন, টিভিতে ঘোড়াদৌড় দেখে ছিলাম সরাসরি কখনো দেখি নাই। শহরে কোথাও ঘোড়াদৌড় হয় না। তাই বাবার সাথে ঢাকা থেকে এখনে ঘোড়াদৌড় দেখতে এসেছি। এ আয়োজন দেখতে আমার মতো অনেক মানুষ দূর-দূরান্ত থেকে এসেছেন। এ প্রতিযোগিতা দেখে খুবই ভালো লাগছে।
ঘোড়াদৌড় দেখতে আসা নওশিন বলেন, ঘোড়ার দৌড় প্রতিযোগিতা দেখে খুবেই ভালো লাগছে। এমন আয়োজনে হাজারো দর্শকের উপস্থিতিতে আবেগ আপ্লুত হয়েছি। এ প্রতিযোগিতা দেখে হারিয়ে যাওয়া ঐহিত্যকে মনে করিয়ে দিবে। তবে এমন আয়োজন প্রতিবছর হলে ভালো হয়। তাহলে মানুষ গ্রামীণ ঐতিহ্য হারাবে না।
শিক্ষার্থী কাইয়ুম বলেন, নিজ গ্রামে ঘোড়দৌড় দেখতে পেরে আনন্দিত। এলাকার মানুষ ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা দেখতে পেয়ে তারা খুবই মুগ্ধ। এ প্রতিযোগিতা দেখে হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যকে মনে পড়ে যায়। এমন আয়োজন প্রতি বছর হলে দেখতে চান বলেও জানান তিনি।
ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী বেল্লাল বলেন, আমি প্রতিবছর দেশের বিভিন্ন জেলা গিয়ে ঘোড়া দৌড়াই। প্রথমে বেতাগী থেকে এখানে আসতে চাই নাই, কিন্তু থাকতেও পারি নাই। ছোট বেলা থেকেই ঘোড়া দৌড়াই। আমার পালে ৮টি ঘোড়া আছে। ৫টি ঘোড়াই দৌড়ানোর ঘোড়া। এর মধ্যে দেশি-বিদেশি ঘোড়াও আছে। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি বিভিন্ন এলাকায় ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। শারীরিক অবস্থা যতদিন ভালো থাকবে ততদিন তিনি ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিবেন।
রাকিবুল ইসলাম বলেন, আমি ৬-৭বছর বয়স থেকেই ঘোড়া দৌড়াই। শখের জন্য ঘোড়া দৌড়াই। অনেক মানুষ দেখে আমার ভালো লাগে এই জন্যই ঘোড়া দৌড়াই। ঘোড়া দৌড়ানো আমার শখের বিষয়। অনেক প্রতিযোগিতায় তিনি বিজয়ী হয়েছেন। সেই ধারাবাহিকতায় আজও তিনি বিজয়ী হন।
এ প্রতিযোগিতার আয়োজক ইন্দ্রিস হোসেন বলেন, প্রতি বছরের মতো এবছরও মেলা এবং ঘোড়ার দৌড় প্রতিযোগীতার আয়োজন করা হয়েছে। মূলত গ্রামীন ঐতিহ্য ধরে রাখতে ও বিনোদনের উদ্দেশ্যেই এ আয়োজন করা হয়।
মঠবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. শাহজালাল হাওলাদার বলেন, ৩ দিনের এ আয়োজন শেষে প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়া বিজয়ী ঘোড়ার সাওয়ারদের পুরস্কৃত করা হয়েছে। গ্রামীন ঐতিহ্য ধরে রাখতে ও মাদক মুক্ত সামজ গড়ে তুলতে এ আয়োজন করা হয়।
এ অনুষ্ঠানে ৬নং মঠবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. শাহজালাল হাওলাদারের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি ছিলেন রাজাপুর উপজেলা সেচ্ছাসেবক লীগের আহবায়ক নাসির উদ্দিন মৃধা। বিশেষ অতিথি ছিলেন সমাজসেবক লিটন খান। মেলা পরিচালনায় ছিলেন রাজাপুর উপজেলা ছাত্রলীগের সহ সভাপতি ইদ্রিস মৃধা।
প্রতিযোগিতার পাশাপাশি মেলায় দোকানীরা বিভিন্ন ধরনের গ্রামীণ খেলনা এবং বাহারি খাবারের পসরা বসানো হয়। গ্রামীণ এ মেলা প্রতিদিন সকাল থেকে চলছিলো রাত পর্যন্ত। আয়োজকরা জানান, গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে, বাংলার সংস্কৃতি মনে করিয়ে দিতে আর এলাকাবাসীকে আনন্দ দিতেই এই আয়োজন।